বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের ইতিহাস
বায়তুল মোকাররম মসজিদ বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ এবং অন্যতম বৃহৎ ইসলামিক স্থাপনা। এটি রাজধানী ঢাকার গুলিস্তান এলাকায়, শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। মসজিদটি তার ব্যতিক্রমী স্থাপত্যশৈলী, ধর্মীয় গুরুত্ব ও ইতিহাসের কারণে বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্থান।
১. নির্মাণের পটভূমি ও ইতিহাস
বাংলাদেশের বৃহৎ একটি মসজিদ নির্মাণের ধারণা আসে ১৯৫৯ সালে, যখন ঢাকায় দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং মুসলমানদের জন্য একটি কেন্দ্রীয় মসজিদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
প্রস্তাব ও পরিকল্পনা:
- ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া প্রথম এই মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন।
- তিনি পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) তৎকালীন সরকার এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সহযোগিতায় মসজিদের জন্য জমি বরাদ্দ করেন।
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন:
- ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি, পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আয়ুব খান মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
- মূল নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৬০ সালে, এবং সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয় ১৯৬৮ সালে।
জাতীয় মসজিদ হিসেবে স্বীকৃতি:
- ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর, বাংলাদেশ সরকার বায়তুল মোকাররমকে দেশের জাতীয় মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করে।
- বর্তমানে এটি শুধু নামাজের স্থানই নয়, বরং এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ইসলামিক ও সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২. স্থাপত্যশৈলী ও নকশা
মক্কার কাবা শরিফের অনুকরণে ডিজাইন
বায়তুল মোকাররম মসজিদের মূল নকশা প্রণয়ন করেন বিখ্যাত স্থপতি আব্দুল হুসেন থারিয়া। এই মসজিদের অন্যতম বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এটি পবিত্র কাবা শরিফের আকৃতির অনুকরণে নির্মিত।
প্রধান স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য:
- চতুষ্কোণ (স্কয়ার) আকৃতির প্রধান ভবন – কাবা শরিফের মতো দেখতে।
- উঁচু প্ল্যাটফর্মে অবস্থিত – নিচের রাস্তা থেকে মসজিদের প্রবেশপথ উঁচু, যা মসজিদের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে।
- উদার খোলা জায়গা – মসজিদের চারপাশে বড় খোলা জায়গা ও প্রশস্ত সিঁড়ি রয়েছে।
- উচ্চতা ও আকার: মসজিদের মূল ভবন প্রায় ৮০ ফুট উঁচু এবং ৯৯ ফুট দৈর্ঘ্যের।
- ভেতরের অংশ:
- বিশাল প্রধান নামাজ কক্ষ
- আলাদা বারান্দা ও উন্মুক্ত চত্বর
- মার্বেল ও মোজাইক পাথরের কারুকাজ
- ছাদের ওপরে গোলাকার গম্বুজ নেই, যা এটিকে অন্যান্য মসজিদ থেকে আলাদা করেছে।
৩. নামাজ ও ধারণক্ষমতা
বায়তুল মোকাররম মসজিদ নির্মাণের সময় থেকে এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম নামাজের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
- প্রাথমিক ধারণক্ষমতা: ৪০,০০০ মুসল্লি
- বর্তমানে: সম্প্রসারণের ফলে ধারণক্ষমতা প্রায় ১ লাখ মুসল্লি
- বিশেষ দিনগুলোতে (যেমন রমজান, ঈদ): মুসল্লিদের সংখ্যা আরও বেশি হয়, এবং অনেক মুসল্লি মসজিদের বাইরেও নামাজ আদায় করেন।
৪. সম্প্রসারণ ও সংস্কার প্রকল্প
প্রথম সম্প্রসারণ (১৯৮০-এর দশক)
বাংলাদেশ সরকার বায়তুল মোকাররম মসজিদের জন্য নতুন সম্প্রসারণ প্রকল্প হাতে নেয়। এতে নিচতলায় একটি বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়, যার আয় থেকে মসজিদের পরিচালনা ব্যয় বহন করা হয়।
বর্তমান সম্প্রসারণ প্রকল্প (২০০৮-বর্তমান)
বর্তমানে বায়তুল মোকাররমের উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্য বাংলাদেশ সরকার বড় আকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার মধ্যে রয়েছে:
- নতুন অতিরিক্ত ভবন নির্মাণ
- নতুন মিনার ও গম্বুজ স্থাপন
- শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যুক্ত করা
- বিশাল ওজুখানা ও ইসলামিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন
এই প্রকল্প শেষ হলে এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মসজিদে পরিণত হবে।
৫. ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব
বায়তুল মোকাররম শুধু নামাজ আদায়ের স্থান নয়, এটি বাংলাদেশের ইসলামিক কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
ধর্মীয় দিক:
- দেশের প্রধান জুমার নামাজ এখানে অনুষ্ঠিত হয়।
- রমজান মাসে এখানে তারাবিহ, ইফতার ও ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার জামাত হয়।
- প্রতি বছর শবে কদর, শবে বরাত ও অন্যান্য ধর্মীয় উৎসব পালন করা হয়।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক:
- এটি ইসলামিক গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
- হজ ও ওমরাহ বিষয়ক সেমিনার ও প্রশিক্ষণ এখানে অনুষ্ঠিত হয়।
- ইসলামিক বই ও কুরআন বিতরণ কর্মসূচি পরিচালিত হয়।
- বিপুলসংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসল্লির জন্য এটি একটি আধ্যাত্মিক মিলনমেলা।
৬. বায়তুল মোকাররম সংলগ্ন বাণিজ্যিক এলাকা
- মসজিদের নিচতলায় রয়েছে বায়তুল মোকাররম মার্কেট, যা ঢাকার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র।
- এখানে ইসলামিক পোশাক, কোরআন শরিফ, তসবিহ, জায়নামাজসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাধারণ পণ্য বিক্রি হয়।
৭. আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও গুরুত্ব
বায়তুল মোকাররম মসজিদ বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামিক স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন হিসেবে পরিচিত।
- এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ মসজিদ।
- অনেক বিদেশি মুসল্লি ও পর্যটক এটি দেখতে আসেন।
- এটি ইসলামিক ঐতিহ্যের একটি মূল্যবান নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়।
উপসংহার
বায়তুল মোকাররম মসজিদ শুধু বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ নয়, এটি দেশের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গৌরবের প্রতীক। কাবা শরিফের আদলে তৈরি হওয়ায় এটি স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। বর্তমান সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হলে এটি আরও বৃহৎ পরিসরে ইসলামিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ পাবে এবং বিশ্বমানের একটি ইসলামিক স্থাপনায় পরিণত হবে।
আপনার যদি আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে বলুন! 😊
0 Comments