মেজর ডালিমের ইতিহাস বিস্তারিত জানতে হলে আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড, ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থান, এবং তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে বুঝতে হবে। তাঁর ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিতর্কিত। নিচে মেজর ডালিম এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:
মেজর ডালিমের প্রাথমিক জীবন:
- জন্ম ও শিক্ষা: মেজর ডালিম (আবু তাহের মোহাম্মদ দালিম) চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। পাকিস্তান সামরিক একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে কমিশন লাভ করেন।
- স্বাধীনতার পর: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং মেজর পদে উন্নীত হন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও অভ্যুত্থানে ভূমিকা:
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিলেন একটি দল যা সেনাবাহিনীর কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যদের নিয়ে গঠিত। মেজর ডালিম ছিলেন এই দলটির অন্যতম প্রধান সদস্য।
- পরিকল্পনা ও ভূমিকা:
- মেজর ডালিম এবং তাঁর সহযোগীরা বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁরা দাবি করেন, দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা (বাকশাল) চালুর কারণে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছিল।
- হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন মেজর ফারুক রহমান, মেজর রশিদ এবং অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তারা। মেজর ডালিম এই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন এবং অভ্যুত্থান সফল করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
- ঘটনার বিবরণ:
- বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে সেনাবাহিনীর একটি দল প্রবেশ করে হত্যাকাণ্ড চালায়।
- বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যসহ অন্তত ১৮ জনকে হত্যা করা হয়।
- হত্যার পর মেজর ডালিম রেডিওতে ঘোষণা দেন যে, সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে এবং একটি নতুন শাসন ব্যবস্থা চালু হচ্ছে।
অভ্যুত্থানের পরবর্তী জীবন:
-
বিদেশে পালানো: বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মেজর ডালিম এবং অন্যান্য অভিযুক্তরা সামরিক বাহিনীতে শক্তিশালী অবস্থানে চলে যান। তবে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী রাজনৈতিক সংকটে তাঁদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর তাঁরা বিভিন্ন দেশে (যেমন লিবিয়া, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা) পালিয়ে যান এবং সেখানে আত্মগোপনে থাকেন।
-
পলাতক জীবন: মেজর ডালিম দীর্ঘদিন বিদেশে বসবাস করেছেন এবং বিভিন্ন পেশায় জড়িত ছিলেন। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যবসা করতেন বলে জানা যায়।
বিচার ও রায়:
- ১৯৯৬ সালে মামলা পুনরুজ্জীবিত: ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি পুনরায় চালু হয়।
- ২০১০ সালে রায়: ২০১০ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট মেজর ডালিমসহ অন্য অভিযুক্তদের অনুপস্থিতিতেই মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করে। তবে মেজর ডালিম পলাতক থাকায় রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
মেজর ডালিম সম্পর্কে বিতর্ক ও সমালোচনা:
- তাঁর দাবি: মেজর ডালিম এবং তাঁর সহযোগীরা দাবি করেন, তাঁরা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করেছিলেন এবং একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
- সমালোচনা:
- বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং সামরিক অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় ভয়াবহ প্রভাব ফেলে।
- মেজর ডালিমের মতো সামরিক কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য হুমকি ছিল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রভাব:
মেজর ডালিম এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত অন্যান্যদের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে।
- বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে রুদ্ধ করেছিল এবং সামরিক শাসনের উত্থান ঘটায়।
- এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়, যা পরবর্তী কয়েক দশক ধরে চলতে থাকে।
উপসংহার:
মেজর ডালিমের ইতিহাস শুধু একটি ব্যক্তির জীবন নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অন্যতম অধ্যায়। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, কীভাবে সামরিক বাহিনীর একটি অংশ দেশের গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। তাঁর কার্যকলাপ আজও আলোচনা ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
আপনি যদি আরও নির্দিষ্ট তথ্য চান, যেমন তাঁর জীবনের নির্দিষ্ট ঘটনা, বিচার প্রক্রিয়া, বা তাঁর পলাতক জীবনের বিস্তারিত, আমাকে জানাবেন।
0 Comments