বায়তুল্লাহর ইতিহাস ও বিবরণ: বিশদ আলোচনা
প্রথম নির্মাণ: আদম (আ.) এর সময়
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, বায়তুল্লাহর নির্মাণ শুরু হয় পৃথিবীতে মানবজাতির আদি পিতা আদম (আ.)-এর সময়। আদম (আ.) যখন পৃথিবীতে প্রেরিত হন, তখন আল্লাহর নির্দেশে তিনি প্রথম বায়তুল্লাহ নির্মাণ করেন। বলা হয়, এটি পৃথিবীর সর্বপ্রথম ইবাদতের ঘর। পরবর্তী সময়ে আদম (আ.) এর নির্মিত কাবা ধ্বংস হয়ে যায়, তবে এর স্থানটি আল্লাহর পক্ষ থেকে পুনরায় নির্ধারিত ছিল।
ইবরাহিম (আ.) এবং ইসমাইল (আ.) এর পুনর্নির্মাণ
ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে তার পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে বায়তুল্লাহ পুনর্নির্মাণ করেন। তারা কাবার ভিত্তি পুনর্নির্মাণ করে এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করেন:
"হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের উভয়কে আপনার অনুগত করে নিন এবং আমাদের বংশধরদের মধ্যেও একটি অনুগত সম্প্রদায় সৃষ্টি করুন। আমাদেরকে আমাদের ইবাদতের পদ্ধতি শিখিয়ে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাকারী, পরম দয়ালু।"
(সুরা আল-বাকারা, আয়াত: ১২৮)
ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) নির্মাণকালে হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) কাবার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্থাপন করেন। হাজরে আসওয়াদ স্বর্গ থেকে আগত পাথর হিসেবে বিশেষ মর্যাদা পায়।
কাবার জাহেলি যুগের ইতিহাস
ইসলামের আগের যুগে, কাবাকে ঘিরে আরব গোত্রগুলোর একটি সম্মিলিত ধর্মীয় কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। যদিও কাবা মূলত একত্ববাদের প্রতীক ছিল, কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র এখানে মূর্তি স্থাপন করেছিল। এর মধ্যে লাত, মানাত, উজ্জা এবং হুবল ছিল বিখ্যাত মূর্তি।
মহানবী (সা.) এর আগমনের পর কাবা
ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) কুরাইশ গোত্রের একজন সদস্য হওয়ায় কাবার সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল। তিনি নবুয়ত পাওয়ার আগেই কাবা সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। একটি বিখ্যাত ঘটনার উল্লেখ রয়েছে যেখানে হাজরে আসওয়াদ পুনঃস্থাপনের সময় কুরাইশদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়। মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বিচক্ষণতার মাধ্যমে এটি সমাধান করেন।
মক্কা বিজয় এবং কাবা পবিত্রকরণ
মহানবী (সা.) ৮ হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর কাবাকে সকল মূর্তির প্রভাব থেকে মুক্ত করেন। তিনি ঘোষণা করেন:
"সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ার জন্যই।"
(সুরা আল-ইসরা, আয়াত: ৮১)
এরপর থেকে কাবা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্য পবিত্র থাকে।
কাবার স্থাপত্য ও গঠন
বর্তমান কাবার গঠন একটি আয়তাকার ভবন। এটি কালো কাপড়ে আবৃত, যা কিসওয়া নামে পরিচিত। প্রতি বছর হজের সময় এই কিসওয়া পরিবর্তন করা হয়।
কাবার গুরুত্বপূর্ণ অংশ:
- হাজরে আসওয়াদ: দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত কালো পাথর।
- মিজাব-উর-রহমা: কাবার ছাদের উপর একটি সোনার নালী, যেখান দিয়ে বৃষ্টির পানি বের হয়।
- হাতিম: অর্ধবৃত্তাকার স্থান, যা কাবার অংশ বলে বিবেচিত।
- মাকামে ইবরাহিম: পাথরটি যেখানে ইবরাহিম (আ.) দাঁড়িয়ে কাবা নির্মাণ করেছিলেন।
তাওয়াফ এবং মুসলমানদের ইবাদত
কাবার চারপাশে সাতবার প্রদক্ষিণ করা হয়, যা তাওয়াফ নামে পরিচিত। এটি হজ ও উমরাহর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মুসলমানরা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে থেকে কাবার দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন।
ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ও সংস্কার
- অমর ইবনে লুহাই যুগ: মূর্তি পূজা কাবায় প্রবেশ করেছিল।
- খলিফা ওমর (রা.) ও উসমান (রা.): কাবা সংলগ্ন মসজিদুল হারামের সম্প্রসারণ।
- ইবনে জুবায়েরের সময়: মক্কার একটি বড় বন্যার কারণে কাবার একটি অংশ ভেঙে গেলে পুনর্নির্মাণ করা হয়।
- উসমানি খলিফাতের যুগ: কাবা ও মসজিদুল হারামে উল্লেখযোগ্য সংস্কার ও সম্প্রসারণ।
- সৌদি যুগ: বর্তমান সৌদি সরকার কাবার চারপাশে মসজিদুল হারামকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করেছে।
বায়তুল্লাহর গুরুত্ব
- এটি মুসলিম ঐক্যের প্রতীক।
- ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে হজ একটি, যা কাবাকে কেন্দ্র করেই পালন করা হয়।
- এটি একত্ববাদের প্রতীক এবং মুসলমানদের আত্মিক ও ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্র।
বায়তুল্লাহর ইতিহাস মানব সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি কেবল একটি ভবন নয়; এটি বিশ্বাস, ঐক্য এবং আনুগত্যের প্রতীক।

0 Comments