হযরত খাদিজা (রা.)-এর জীবনী
🔹 জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
হযরত খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা.) ইসলামের প্রথম নারী মুসলিম, রাসূল (সা.)-এর প্রথম স্ত্রী এবং ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারী। তিনি মক্কার কুরাইশ বংশের আসাদ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন।
📌 পুরো নাম: খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল উজ্জা
📌 পিতার নাম: খুয়াইলিদ ইবনে আসাদ (মক্কার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও নেতা)
📌 মাতার নাম: ফাতিমা বিনতে যায়েদা
📌 উপাধি: "তাহিরা" (পবিত্র নারী) – সততা, শুদ্ধতা ও মহৎ চরিত্রের জন্য এই উপাধি পেয়েছিলেন
তিনি ছিলেন কুরাইশ বংশের সম্ভ্রান্ত ও ধনী নারীদের একজন। তাঁর পরিবার ব্যবসার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল, এবং তিনি নিজেও ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ ব্যবসায়ী।
🔹 ব্যবসায়িক জীবন ও খ্যাতি
হযরত খাদিজা (রা.)-এর বাবা ছিলেন এক ধনী ব্যবসায়ী। তিনি বাবার মৃত্যুর পর নিজেই ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং খুব দক্ষতার সাথে তা পরিচালনা করেন।
📌 ব্যবসায়ের প্রসার: খাদিজা (রা.)-এর ব্যবসা এতটাই সফল ছিল যে তাঁর কারভান (ব্যবসায়িক কাফেলা) একাই কুরাইশদের অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাফেলার চেয়েও বড় ছিল।
📌 সততার খ্যাতি: ব্যবসার ক্ষেত্রে তিনি ন্যায়নিষ্ঠা ও সততার জন্য পরিচিত ছিলেন। এজন্য তাঁকে "তাহিরা" বলা হতো।
তিনি ব্যবসার জন্য দূরদূরান্তে লোক নিয়োগ করতেন, যারা তাঁর পক্ষে ব্যবসা পরিচালনা করত। একদিন তিনি শুনতে পেলেন যে এক তরুণ মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত সৎ, বিশ্বস্ত ও দক্ষ ব্যবসায়ী।
📌 রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে প্রথম পরিচয়:
খাদিজা (রা.) রাসূল (সা.)-কে তাঁর ব্যবসার পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেন। রাসূল (সা.) খাদিজা (রা.)-এর মাল নিয়ে সিরিয়ার বসরা শহরে ব্যবসায়িক সফর করেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন খাদিজা (রা.)-এর ক্রীতদাস মাইসারা।
যখন ব্যবসা শেষে রাসূল (সা.) ফিরে আসলেন, তখন মাইসারা খাদিজা (রা.)-কে রাসূল (সা.)-এর সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং অসাধারণ চরিত্র সম্পর্কে জানালেন। এতে খাদিজা (রা.) তাঁর প্রতি আরও মুগ্ধ হয়ে পড়েন।
🔹 রাসূল (সা.)-এর সঙ্গে বিবাহ
হযরত খাদিজা (রা.) রাসূল (সা.)-এর সততা ও চরিত্র দেখে নিজেই তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান।
📌 বিয়ের সময়:
- খাদিজা (রা.)-এর বয়স ছিল ৪০ বছর
- রাসূল (সা.)-এর বয়স ছিল ২৫ বছর
📌 নিকাহ পরিচালনা:
- রাসূল (সা.)-এর চাচা আবু তালিব বিবাহের খুতবা প্রদান করেন।
- খাদিজা (রা.)-এর চাচা আমর ইবনে আসাদ তাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন।
- মহর ছিল ৫০০ দিরহাম।
📌 দাম্পত্য জীবন:
- এই দাম্পত্য জীবন ছিল ২৫ বছর দীর্ঘ।
- খাদিজা (রা.) রাসূল (সা.)-এর একমাত্র স্ত্রী, যখন তিনি জীবিত ছিলেন, তখন রাসূল (সা.) দ্বিতীয় কোনো বিয়ে করেননি।
🔹 সন্তানসন্ততি
রাসূল (সা.) ও খাদিজা (রা.)-এর ৬ জন সন্তান জন্মগ্রহণ করেন:
1️⃣ কাসিম – শৈশবে ইন্তেকাল করেন
2️⃣ আবদুল্লাহ (তাহির ও তাইয়িব নামে পরিচিত) – শৈশবে ইন্তেকাল করেন
3️⃣ যয়নব (রা.) – আবুল আস ইবনে রবী’র স্ত্রী
4️⃣ রুকাইয়া (রা.) – প্রথমে উতবা ইবনে আবু লাহাবের স্ত্রী ছিলেন, পরে হযরত ওসমান (রা.)-এর স্ত্রী হন
5️⃣ উম্মে কুলসুম (রা.) – হযরত ওসমান (রা.)-এর দ্বিতীয় স্ত্রী
6️⃣ ফাতিমা (রা.) – যিনি পরবর্তীতে হযরত আলী (রা.)-এর স্ত্রী হন
🔹 ইসলাম গ্রহণ ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান
✅ প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী: খাদিজা (রা.)-ই প্রথম ব্যক্তি, যিনি রাসূল (সা.)-এর নবুয়তের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে ঈমান গ্রহণ করেন।
✅ মানসিক সমর্থন: রাসূল (সা.) যখন হেরা গুহা থেকে আল্লাহর ওহি পেয়ে ফিরে আসেন এবং শঙ্কিত হন, তখন খাদিজা (রা.) তাঁকে সান্ত্বনা দেন।
✅ আর্থিক সহায়তা: রাসূল (সা.)-এর দাওয়াতের জন্য তিনি তাঁর সর্বস্ব ব্যয় করেন।
✅ শিবে আবু তালিবের কষ্ট সহ্য: কুরাইশরা যখন রাসূল (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের বয়কট করে, তখন খাদিজা (রা.) স্বামীর পাশে থেকে সব কষ্ট সহ্য করেন।
🔹 ইন্তেকাল ও শোকাবহ বছর
📌 মৃত্যুর সময়: ৬২০ খ্রিস্টাব্দ, ৬৫ বছর বয়সে
📌 মৃত্যুর বছর: নবুয়তের ১০ম বছর, যা "আমুল হুজন" (দুঃখের বছর) নামে পরিচিত।
📌 কবর: মক্কার জান্নাতুল মুআল্লা কবরস্থানে দাফন করা হয়।
খাদিজা (রা.)-এর ইন্তেকালে রাসূল (সা.) অত্যন্ত শোকাহত হন।
🔹 মর্যাদা ও বিশেষত্ব
✅ "উম্মুল মুমিনীন" (মুমিনদের মা) উপাধি লাভ করেন।
✅ জান্নাতে খাদিজা (রা.)-এর জন্য আল্লাহ নিজ হাতে একটি মুক্তার প্রাসাদ তৈরি করেছেন (সহিহ বুখারি, মুসলিম)।
✅ রাসূল (সা.) বলতেন:
📖 "দুনিয়াতে আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল খাদিজা।" (মুসলিম)
✅ খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যুর পরও রাসূল (সা.) তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করতেন এবং তাঁর বন্ধুদের প্রতি সদয় আচরণ করতেন।
🔹 উপসংহার
হযরত খাদিজা (রা.) ছিলেন ইসলামের অন্যতম মহান নারী, যিনি রাসূল (সা.)-এর পাশে দাঁড়িয়ে ইসলামের প্রাথমিক যুগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর দানশীলতা, আত্মত্যাগ, এবং ভালোবাসা মুসলমানদের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
📌 আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন, আমিন! 🤲
0 Comments