কুরআন ও হাদীসের আলোকে যাকাত ফরজ হওয়ার বিধান
ইসলামে যাকাত ফরজ একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ইবাদত। এটি ধনী মুসলমানদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক কর, যা দরিদ্রদের কল্যাণের জন্য ব্যয় করা হয়। কুরআন ও হাদীসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, যাকাত আদায় না করা গুরুতর অপরাধ এবং এটি ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ।
১. কুরআনে যাকাত ফরজ হওয়ার প্রমাণ
📖 কুরআনে অসংখ্য আয়াতে যাকাতের গুরুত্ব ও বাধ্যবাধকতা বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আয়াত হলো:
(১) যাকাত আদায়ের নির্দেশ
🔹 সুরা আল-বাকারা (২:৪৩)
وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ
“তোমরা সালাত কায়েম করো এবং যাকাত প্রদান করো এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু করো।”
🔹 সুরা আত-তওবা (৯:৬০)
إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ...
“যাকাত শুধু গরিব, মিসকিন, যাকাত সংগ্রহকারীদের জন্য এবং যাদের হৃদয় ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়...”
🔹 সুরা আল-মুনাফিকুন (৬৩:১০)
“তোমরা যাকাত দাও, অন্যথায় মৃত্যুর সময় তোমরা বলবে, ‘হে আমার রব! যদি আমাকে অল্প কিছু সময় অবকাশ দাও, তাহলে আমি দান-সদকা করব ও সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হব।’”
২. হাদীসে যাকাত ফরজ হওয়ার বিধান
📜 নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাকাত সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেছেন। কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাদীস:
(১) যাকাত ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ
📖 রাসূল (ﷺ) বলেন:
“ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত:
১) এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল,
২) সালাত কায়েম করা,
৩) যাকাত দেওয়া,
৪) রমজানের রোজা রাখা,
৫) হজ্ব করা (যদি সামর্থ্য থাকে)।”
📚 (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮, সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬)
(২) যাকাত না দিলে শাস্তির ঘোষণা
📖 রাসূল (ﷺ) বলেন:
“যে ব্যক্তি আল্লাহ তার সম্পদের মাধ্যমে তাকে ধনী করেছেন, কিন্তু সে যাকাত দেয় না, কিয়ামতের দিন সেই সম্পদ বিষাক্ত সাপের রূপ ধারণ করবে এবং তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে।”
📚 (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৪০৩)
(৩) ধনীদের উপর দরিদ্রদের অধিকার
📖 রাসূল (ﷺ) বলেন:
“আল্লাহ ধনীদের সম্পদে গরিবদের জন্য হক নির্ধারণ করেছেন। যে ব্যক্তি এই হক প্রদান করবে না, কিয়ামতের দিন তার সম্পদ ভয়ংকর শাস্তির কারণ হবে।”
📚 (তিরমিজি, হাদিস: ৬৪৪)
(৪) রাষ্ট্র যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করবে
📖 রাসূল (ﷺ) যখন মুআয ইবন জাবাল (রা.)-কে ইয়েমেন পাঠান, তখন বলেছিলেন:
“তুমি তাদের জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরজ করেছেন, যা তাদের ধনীদের থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হবে।”
📚 (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৪৯৬, সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯)
৩. যাকাত না দিলে শাস্তি
✅ যারা যাকাত আদায় করে না, তাদের জন্য ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা রয়েছে:
🔹 সুরা আত-তওবা (৯:৩৪-৩৫)
“যারা স্বর্ণ ও রূপা সঞ্চিত রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা গরম করা হবে এবং তাদের কপাল, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দগ্ধ করা হবে...”
🔹 হাদীসে এসেছে:
“যে ব্যক্তি তার উট, গরু, ছাগল বা সম্পদের যাকাত প্রদান করবে না, কিয়ামতের দিন সেই সম্পদ আগুনে পরিণত হবে এবং তাকে দগ্ধ করবে।”
📚 (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৮৭)
৪. সংক্ষেপে যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত
✔ মুসলিম হতে হবে
✔ বালিগ (প্রাপ্তবয়স্ক) হতে হবে
✔ আকılসম্পন্ন হতে হবে
✔ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে
✔ ঋণমুক্ত হতে হবে (যদি ঋণ বেশি হয়, তাহলে যাকাত ফরজ নয়)
✔ এক বছর অতিক্রান্ত হতে হবে (হিজরি বছর অনুযায়ী)
📌 নিসাব পরিমাণ সম্পদ:
- ৭.৫ ভরি (৮৭.৪৮ গ্রাম) স্বর্ণ বা
- ৫২.৫ ভরি (৬১২.৩৬ গ্রাম) রূপা
- অথবা সমপরিমাণ নগদ টাকা বা সম্পদ
📌 যাকাতের হার:
- মোট সম্পদের ২.৫% যাকাত দিতে হবে।
৫. যাকাত আদায় করলে কী লাভ?
✅ আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের ওয়াদা
✅ সম্পদের বরকত ও পবিত্রতা বৃদ্ধি
✅ গরিব ও দুঃস্থদের সহায়তা করা
✅ সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
✅ দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখা
🔹 সুরা আল-বাকারা (২:২৭৭)
“যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে, তাদের জন্য রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রতিদান, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।”
🔹 উপসংহার
যাকাত শুধু অর্থনৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যম। এটি ধনী ও গরিবের মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতা তৈরি করে। কুরআন ও হাদীসের আলোকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, যাকাত আদায় করা বাধ্যতামূলক, এবং তা না দিলে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।
🕌 আল্লাহ আমাদের সবাইকে যথাযথভাবে যাকাত আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন! 🤲
0 Comments