ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP): ইতিহাস, আদর্শ ও আধুনিক প্রভাব
ভারতের রাজনীতিতে আজকের দিনে যে নামটি সর্বাধিক আলোচিত, তা হলো ভারতীয় জনতা পার্টি (Bharatiya Janata Party - BJP)। স্বাধীনতার পর ভারতীয় রাজনীতিতে দীর্ঘদিন কংগ্রেসের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। কিন্তু ১৯৮০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে BJP নিজেদের অবস্থান শক্ত করে এবং আজ ভারতের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা BJP-এর ইতিহাস, আদর্শ, সাফল্য, সমালোচনা এবং আধুনিক ভারতের ওপর এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
প্রতিষ্ঠা ও প্রাথমিক ইতিহাস
BJP-এর শিকড় খুঁজতে গেলে যেতে হবে ১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় জনসংঘ (Bharatiya Jana Sangh)-এ। জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ড. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি। এর লক্ষ্য ছিল হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ ও সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে শক্তিশালী করা। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার পর জনসংঘসহ কয়েকটি বিরোধী দল মিলে জনতা পার্টি গঠন করে এবং কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসে। কিন্তু মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে এই জোট টেকেনি। অবশেষে ১৯৮০ সালে জনসংঘের নেতারা বেরিয়ে এসে নতুন দল গঠন করেন, যার নাম রাখা হয় ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP)।
আদর্শ ও দর্শন
BJP-এর মূল রাজনৈতিক দর্শন হলো “অখণ্ড ভারত” ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ। দলটি RSS (Rashtriya Swayamsevak Sangh)-এর আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। BJP বিশ্বাস করে ভারতের জাতীয় পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু হলো হিন্দু সংস্কৃতি।
তাদের মূল দার্শনিক ভিত্তি দীনদয়াল উপাধ্যায়ের “অখণ্ড মানবতাবাদ (Integral Humanism)”, যা ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়।
প্রথম সাফল্য
১৯৮৪ সালের নির্বাচনে BJP মাত্র ২টি আসন পায়, যা তাদের জন্য এক বিরাট ধাক্কা ছিল। কিন্তু এর পরবর্তী সময়ে রাম জন্মভূমি আন্দোলন ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারণে BJP-এর জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। ১৯৯৬ সালে তারা প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসে, যদিও মাত্র ১৩ দিন সরকার টিকে ছিল। পরে ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে NDA জোটের নেতৃত্বে আবার ক্ষমতায় আসে এবং অটল বিহারি বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর নেতৃত্বে ভারত অর্থনৈতিক সংস্কার, তথ্যপ্রযুক্তি, পারমাণবিক শক্তি এবং কূটনীতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করে।
মোদী যুগ ও আধুনিক BJP
২০১৪ সালে BJP একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসে এবং নারেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হন। এটি ছিল স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার, যখন কোনো অ-কংগ্রেস দল এককভাবে এত বড় জয় পায়।
মোদী সরকারের সময় উল্লেখযোগ্য কিছু কর্মসূচি:
-
ডিজিটাল ইন্ডিয়া – প্রযুক্তিকে সাধারণ মানুষের নাগালে আনা।
-
মেক ইন ইন্ডিয়া – দেশীয় শিল্প ও উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ।
-
GST (Goods and Services Tax) – একক কর ব্যবস্থা চালু।
-
আয়ুষ্মান ভারত – স্বাস্থ্যসেবায় সাধারণ মানুষের জন্য বৃহৎ প্রকল্প।
-
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা – গৃহহীনদের ঘর দেওয়ার পরিকল্পনা।
-
উজ্জ্বলা যোজনা – গরিব পরিবারে বিনামূল্যে গ্যাস সংযোগ।
-
অভিনব সিদ্ধান্ত: ২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীর থেকে Article 370 বাতিল করা হয়, যা BJP-এর অন্যতম ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
আন্তর্জাতিক কূটনীতি
BJP নেতৃত্বে ভারত আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হয়েছে। একই সঙ্গে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে সীমান্ত নীতি আরও কড়া হয়েছে। ২০১৬ সালের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং ২০১৯ সালের বালাকোট এয়ারস্ট্রাইক BJP সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা নীতির অংশ।
সমালোচনা ও বিতর্ক
যদিও BJP ভারতের রাজনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে, তবে তাদের বিরুদ্ধে নানা সমালোচনাও রয়েছে:
-
ধর্মীয় মেরুকরণ – হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি অনেক সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভয়ের জন্ম দিয়েছে।
-
অভিযোগিত স্বৈরতান্ত্রিক ধারা – বিরোধীদের অভিযোগ, BJP ক্ষমতায় থেকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করছে।
-
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ – চাকরি সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সমালোচনা রয়েছে।
২০২৪ সালের নির্বাচন
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে BJP একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়, তবে NDA (National Democratic Alliance)-এর সমর্থনে তৃতীয়বার সরকার গঠন করে। মোদী আবার প্রধানমন্ত্রী হন, তবে এবার সরকারের ওপর জোটসঙ্গীদের প্রভাব বেড়েছে।
সারসংক্ষেপ
ভারতীয় জনতা পার্টি আজ ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। একদিকে হিন্দুত্ব, সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে তারা সমর্থন পেয়েছে; অন্যদিকে ধর্মীয় রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে।
ভারতের রাজনীতির ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই নির্ভর করবে BJP-এর কার্যকলাপের ওপর। তারা যদি উন্নয়নমূলক কর্মসূচি চালিয়ে যেতে পারে এবং সবার আস্থা অর্জন করতে পারে, তবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হবে। আবার যদি ধর্মীয় মেরুকরণ ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে, তবে রাজনৈতিক সমীকরণ পরিবর্তনও হতে পারে।

0 Comments